English

মানবতার ডাক্তার অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম

মানবতার ডাক্তার অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম

ইসরাত জাহান :

মানুষ যখন অসুস্থ হয় তখন রোগী ও তার পরিবার সৃষ্টিকর্তার পর ডাক্তারকেই পরম শ্রদ্ধা এবং ভক্তিতে বিশ্বাস করেন। সেজন্যই একজন ডাক্তারকে হৃদয়বান হতে হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের ডাক্তার খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। তবুও একেবারেই যে নেই তা বলবোনা। রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেয়ার সাথে মানসিক প্রশান্তি দেয়া ডাক্তারের সংখ্যা নেহাতই কম বললেও ভুল হবে না। তবুও পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা উদাহরন হিসেবে কাউকে না কাউকে পাঠান অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে মানুষের হৃদয়ে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখতে। এমনই একজন মমতাময়ী মানবতার ডাক্তার অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম যিনি কিডনি প্রতিস্থাপনে স্বত:স্বিদ্ধ। তাকে নিয়ে আজকের এ প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন. . . . . ইসরাত জাহান     

দীর্ঘ করোনাকালীন সময়ে দেশের প্রায় সব হাসপাতালগুলোতে কিডনি অপারেশন তো দূরের কথা  এমনকি ডায়ালিসিস করাও বন্ধ ছিল সেখানে শ্যামলী সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে অপারেশনসহ ডায়ালাইসিস চালু ছিল। করোনাকালীন সময়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ৩২০টির বেশি কিডনি। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে ২০২০ সালে সর্বমোট সাড়ে ৮ লাখের বেশী মানুষ মারা গেছেন। শীর্ষ মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, শ্বাসতন্ত্রের অসুখ, ক্যান্সার, অ্যাজমা, কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা, নিউমোনিয় ইত্যাদি। কিডনি জটিলতায় দেশে ২০১৯ সালে যত মানুষ মারা গেছেন, তার প্রায় ৩ গুণ মানুষ মারা গেছেন ২০২০ সালে। ২০২০ সালে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৮ হাজার ১৭ জন। আর ২০১৯ সালে মারা যান ১০ হাজার ৬২২ জন। এতে করে এটা বলা  যেতেই পারে, যে করোনা ভাইরাসের অজুহাতে হাসপাতাল বন্ধের কারণে বিনা চিকিৎসায় অনেক বেশী লোক মারা গেছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হয়েও একের পর এক হাসপাতালে ঘুরেও কিডনির জটিলতায় অসুস্থ একজন চাকুরিকালীন অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার যাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চিনতেন এবং জানতেন তিনিও মারা গেছেন। অবশেষে কুর্মিটোলা হাসপাতালে যখন চিকিৎসার সুযোগ হলো তখন তিনি মরনাপন্ন অবস্থায়। বলতে গেলে প্রায় বিনা চিকিৎসায় তার মৃত্যু হলো। যতদূর মনে পরে তার মৃত্যুর পর সব হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিস করার সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।  

এখন আমি কথা বলছি ডাক্তার অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম যিনি এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন ১০৭৬টি। মহামারীর সময় করেছেন ৩২০টি। রোগী এবং ডোনার, দুটা অপারেশনই তিনি নিজেই করেন অপারেশন খরচ ছাড়াই। ফলে রোগীর ৫০  থেকে ৬০ হাজার টাকা কম খরচ হয়। সিকেডি হাসপাতাল একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যে প্রতিষ্ঠানটি বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে ২০১৪ সালে মানুষকে সেবা দেয়ার মূল লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বলেন তাদের কাছে অর্থ নয়, সেবাই প্রথম এটা মাথায় রেখেই এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়।

তিনি মানবসেবার মহান ব্রত নিয়েই চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। পাবনার ঈশ্বরদীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মো. আমিনুল ইসলামের ছেলে তিনি। নিজের পেশাকে সামাজিক ও আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের সিঁড়ি না বানিয়ে বানিয়েছেন মাতবতার সিঁড়ির হাসপাতাল। মাত্র দুই লাখ ১০ হাজার টাকার প্যাকেজ, যিনি কিডনি দেবেন এবং যিনি গ্রহণ করবেন; তাদের জন্য। এ প্যাকেজে রয়েছে ১৫ দিনের ঔষধ ও সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ। এছাড়া ১৫ দিন পরও যদি তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তবে সেখানেও আর কোন খরচ লাগে না। নিজ পেশার মাধ্যমে সমাজের নিম্নআয়ের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতার অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছেন এই অধ্যাপক। হাসপাতালে গরীব মানুষের বিকল কিডনি রোগীদের জন্য অল্প খরচে কিডনি ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করেন তিনি। শুধু অপারেশনই নয়, প্রতিস্থাপন পরবর্তী গ্রহীতার সব চিকিৎসাসেবা বিনা খরচে করেন। রোগীদের সঙ্গে কথোপকথনের ভেতর দিয়েই রোগীর সঙ্গে তার সহানুভূতি ও মমতার সম্পর্কের বিষয়টি ফুটে ওঠে। রোগীদের ফলোআপ পরীক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ ও রিপোর্ট দেখার ফিও নেওয়া হয় না তার হাসপাতালে। কিডনি সংরক্ষণের খরচ কমানোর জন্য তিনি বিদেশ থেকে আমদানি করা এক ধরনের দামি তরলের বিকল্পও তৈরি করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এর চেয়ে কম খরচে দেশের বেসরকারি কোনো হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। পাশের দেশ ভারতেও কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য খরচ হয় ১৫ লাখ টাকার বেশি। এ ছাড়া, সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচও তুলনামূলকভাবে কম।

তিনি চিকিৎসাসেবায় দীর্ঘ পথপরিক্রমায় চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বস্ততা, নির্ভরতা ও মমত্ববোধকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে নিয়েছেন। প্রথমবারের মতো সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ করেন ২০০৭ সালে।

কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হলে সিকেডি হাসপাতালেই তার ব্যবস্থা করা হয়। রয়েছে ২২ বেডের একটি ডায়ালাইসিস ইউনিট। খরচ ১ হাজার ৫ শত টাকা। আইসিইউ শয্যার খরচ ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকার মধ্যে।


সহানুভূতি ও মমতার সম্পর্কঃ

অধ্যাপক কামরুল জানান, কিডনি প্রতিস্থাপন করা রোগীর ভালো থাকার অন্যতম শর্ত হলো ফলোআপ করা। প্রথম প্রতি মাসে ১ বার, পরবর্তীতে ২-৩ মাস পর পর ফলোআপ দরকার হয়। অনেক রোগীই ফলোআপের জন্য আসেন। অধ্যাপক কামরুল জানান, এ পর্যন্ত হাসপাতালে মোট ১ হাজার ৭৬টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপন করা সব রোগীর ফলোআপ পরীক্ষা করা এবং রিপোর্ট দেখা হচ্ছে বিনা মূল্যে। প্রতি মাসে হাসপাতালে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী ফলোআপ পরীক্ষার জন্য আসেন। ডা. কামরুল বলেন, ‘ফলোআপের কারণে রোগীর কিডনি অনেক দিন সুস্থ থাকে। যদি ফলোআপ পরীক্ষার জন্য টাকা নেওয়া হতো, তাহলে রোগীদের বড় একটি অংশ কিডনি প্রতিস্থাপনের পর ফলোআপ পরীক্ষা করতে আসতেন না। তাতে অনেকেরই কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকতো।' আগামী দিনে কিডনি দাতাদের মধ্যে কিডনি রোগ দেখা দিলে তাদেরও বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে বলে জানান তিনি। করোনাকালীন সময়ে ২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালে অধ্যাপক কামরুল ও তার ১২ সদস্যের দল ৩২০টিরও বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। সিকেডি হাসপাতালে কিডনি সংযোজনের সাফল্যের হার শতকরা ৯৪ থেকে ৯৬ ভাগ। কিডনি সংযোজনের পর রোগী বেঁচে থাকেন ৫ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত। তবে অনেক দরিদ্র রোগী দামি ওষুধ নিয়মিত সেবন করতে না পারার ফলে তাদের কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায় এবং তা রিজেকশন হয়ে যায়।

অধ্যাপক কামরুল ইসলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১৯৯০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে এফসিপিএস এবং ২০০০ সালে বিএসএমএমইউ থেকে ইউরোলজিতে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ থেকে তিনি এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। কিডনি প্রতিস্থাপন বিষয়ে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে ইউরোলজি সোসাইটি স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। তিনি  ১৯৯৩ সালে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন। তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। 

আর নিজের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে মানবতবাদী মানবদরদী এই চিকিৎসকের নিজেকে নিয়ে মূল্যায়ন হচ্ছে, 'একজন মানুষের চলার জন্য খুব বেশি টাকা পয়সা তো লাগে না। যে সম্মান আমি পেয়েছি, মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, এটাই তো অমূল্য। এটা তো আর টাকা দিয়ে পাওয়া যাবে না।'

অধ্যাপক কামরুল ইসলাম বলেন ‘শুধু দুটি কিডনি নয়, একটি মরদেহ থেকে লিভার, হৃৎপিÐ, দুটি ফুসফুসও অন্যকে দান করা যায়; অর্থাৎ একজন মৃত ব্যক্তির অঙ্গ দিয়ে ৮-১০ জন মানুষকে পুনর্জীবন দেয়া সম্ভব। তাঁদের বয়সও ৫ থেকে ৬৫ হতে হবে। দাতাদের ক্ষেত্রে দুটি কিডনি সুস্থ থাকতে হবে। যার অঙ্গ নেওয়া হবে, তাঁকে মৃত ঘোষণা করতে হবে আইসিইউতে বা নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে এটা অন্য কোথাও মারা গেলে হবেনা। যখন আইসিইউতে থাকা অবস্থায় ব্রেন ডেড রোগীদের মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটে কিন্তু অন্যান্য অঙ্গ তখনো কৃত্রিম উপায়ে কার্যকর থাকে, তখন অনুমতি পেলে আইন অনুযায়ী সেই ব্যক্তির অঙ্গ নিয়ে অন্য দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। যদিও আমরা দেশে এ ক্ষেত্রে তেমন উন্নতি করতে পারিনি। উন্নত বিশ্বে ৮০-৯০ শতাংশ কিডনি এভাবেই প্রতিস্থাপন করা হয়। এজন্যই আমাদের ডোনার সংকট এত বেশি। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের রোগীরা যাতে উপকৃত হন সেটাই আমি চেষ্টা করছি। বিদেশের উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তি আমাদের দেশে চালু করার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, এই কৃতিত্ব আমার একার নয়। কিডনি প্রতিস্থাপন এমন একটা জিনিস যে প্রক্রিয়ায় অনেক ধরনের মানুষ সংযুক্ত থাকে। তাই অনুগ্রহ করে কেউ আমার প্রশংসা করবেন না।’  তিনি বলেন, আশা করা যাচ্ছে খুব শিগগিরি মরণোত্তর অঙ্গদান সম্ভব হবে।